সকালবেলা যখন আজিম মোল্লা এসে পেটে লাথি মারলো , তখনো সজলের হাত দুইটা পিছনে বাঁধা । সজলের অর্ধকাটা আঙুলের চারপাশে তখন মাছি ঘুরে বেড়াচ্ছে । সজল অস্ফুট কণ্ঠে বলল – “পানি ...।।”
“চুপ শালা মালাউনের বাচ্চা । পানি খাবি , না?” ---খেঁকিয়ে উঠলো আজিম মোল্লা ।তারপর লুঙ্গি তুলে সজলের মুখ বরাবর মুতে দিলো । তার সাথে থাকা বাকি দুই রাজাকার হেসে উঠলো । এরপর তারাও আজিম মোল্লাকে অনুসরণ করলো ।সজলের শরীরে এক ফোঁটা শক্তিও ছিল না যে সে তার মুখটা সরিয়ে নিতে পারবে । এরপর আবার তারা সজলকে বন্দুকের বাঁট দিয়ে মারতে লাগলো ।জ্ঞান হারালো সে ।
সজলকে অনেকদিন ধরেই খুঁজছিল মিলিটারিরা । সে আর তার বাহিনী মিলে পরপর তিনটা গ্রাম হানাদারশূন্য করে ফেলেছে , একটা বেস ক্যাম্প সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিয়েছে । হেড কোয়াটারের নির্দেশ – যেভাবেই হোক সজল আর তার বাহিনীকে শেষ করতে হবে । তাই এখানে পোস্টিং হয়েছে বেলুচিস্তান যুদ্ধের অন্যতম অত্যাচারি অফিসার মেজর ইউসুফ বিন নাভেদের । নতুন মেজর এসেই রাজাকারদের দৌড়ের উপর রাখে । আজিম মোল্লারা সারাক্ষণ তার ভয়ে ত্রস্ত থাকে । উঠেপড়ে লাগে তারা সজলের খোঁজে । অবশেষে সজল ধরা পড়ে গতকাল রাতে । এক চামচার কাছ থেকে খবর পেয়ে আজিম মোল্লা মেজর ইউসুফের কাছে যায় ---
“হুজুর , একটা বাত বলার ছিল ।”
“তুম সালা বাঙ্গালকে গাদ্দার । বোলো , ক্যায়া কেহনা মাংতা ?”
“হুজুর , হো যো শালা মালাউন কা বাচ্চা সজল হ্যা না , হো এখন আপনা ঘর ম্যা হ্যা ।”
“তুম সাহি বল রাহে হো না ?”
“জি হুজুর । মেরা পাস একদম পাক্কা ইনফরমেশন আছে ।”
“উসকা ঘার ম্যা কউন কউন হ্যা ?”
“উসকা মা অউর বড় বোন ।”
“ঠিক হ্যা ।তুম যাও । আগার বাত সাহি হুয়া তো তুমহে ইনাম মিলেগা । উসকা যো বেহেন হ্যা হো মেরে বাদ তুমহারা খিদমাত করেগা ।”
“বহুত শুকরিয়া হুজুর ।” গদগদ কণ্ঠে কথাগুলো বলে চলে গেলো আজিম মোল্লা ।
ওদিকে সজলদের বাড়িতে তখন আনন্দ আর ধরে না । প্রায় ৬ মাস পর মা আর দিদির সাথে সজলের দেখা । তাদের আশেপাশের প্রায় সবাই হানাদারদের ভয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছে । কিন্তু সজলের মা যান নি । কারণ তার ১৫ বছরের ছেলেটা যদি যুদ্ধ থেকে এসে তাকে খুঁজে না পায় ! মা যান নি বলে সজলের দিদিরও যাওয়া হয় নি ।
সজল তার বাড়িতে এসেছিল তার আর একজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে । তাদের আগমনে সজলের মা চুলায় ভাত চাপান ; ছেলেকে দুটা গরম ভাত খাওয়াবেন । সজল মেতে উঠে তার দিদির সাথে খুনসুটিতে ।মা ভাত বেড়ে খেতে ডাকেন তাদের ।
সজল যখন ডাল দিয়ে ভাত মেখে প্রথম গ্রাস মুখে তুলতে যাবে ঠিক তখনই সে তাদের উঠোনে ভারী বুটের শব্দ শুনতে পায় । সে তার সহযোদ্ধার দিকে তাকায় । দেখে সে তার স্টেনগানটার দিকে হাত বাড়াচ্ছে । ঠিক যখন সে তার স্টেনগানটা হাতে তুলে নেয় , ঠিক তখনই একটা গুলি এসে লাগে তার গায়ে । সে লুটিয়ে পড়ে । সজল আর তার মা-বোনের হত-বিহব্বলতা কাটতে না কাটতেই ঘরে এসে ঢুকে একদল পাক আর্মি আর রাজাকার আজিম মোল্লা ।পৃথিবীতে বোধহয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীই একমাত্র সেনাবাহিনী যারা সিভিলিয়ানদের নির্দেশ মেনে চলে ।আজিম মোল্লা সজলের দিকে আঙুল তুলে বলে ---“হুজুর , ইএ হ্যা হো মালাউন কা বাচ্চা ।” সাথে সাথে আট-দশ জোড়া বুটের বাড়ি এসে পড়ে সজলের গায়ে , উল্টে যায় তার সামনে থাকা ভাতের বাসন আর তরকারির বাটি ।
“বহুত হুয়া । আব রুখ যাও । ইসকো আচ্ছি তারা সে বান্ধ দো ।” --- মেজরের নির্দেশ ।
আর্মিরা সজলের হাত দুইটা পিছনে মুড়ে বেঁধে ফেলে । সজল তখন জ্ঞান হারানোর পথে । আজিম মোল্লা এসে তখন তার চুলের মুঠি শক্ত করে টেনে ধরে । “শালা মালাউন । তুই এইহানে কি করস ? তোর দেশ তো ভারত । অইহানে পালাইতে পারস নাই ? পাকিস্তান নষ্ট করবি? শালা ভারতের দালাল !”
“সুবেদার আমিনুল আউয়াল , ইস অউরাতকো মার দো। অর এক বাত ইয়াদ রাখনা ইএ লারকাকা আঁখ খুলি রেহনে চাহিয়ে । ” -- কড়া কণ্ঠে হুকুম দিলো মেজর ইউসুফ বিন নাভেদ ।
সুবেদার আমিনুল আউয়াল এই ধরণের অনেক অপারেশন করেছে । কোথাও একটুও হাত কাঁপে নি । কিন্তু আজ কেন জানি তার এই কাজটা করতে তার কোথায় যেন বাঁধছে । সে ভেবেছিল সজল বয়সে যুবক হবে । সে এটা কখনো ভাবে নি সজলের বয়স তার করাচিতে রেখে আসা বড় ছেলের বয়সের সমান হবে । যাই হোক – সে তার রাইফেলটা সজলের মায়ের দিকে তাক করলো । সজলকে তখন জোর করে জাগিয়ে রাখা হয়েছে । সে সব দেখছে , শুনছে ---- কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না । তার মাথাটা সম্পূর্ণ ভোঁতা অনুভূতিতে পূর্ণ । তার ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে তার মায়ের বুকে একবার মাথা রাখতে , শুধু একবার .... হা ঈশ্বর !
সজলের মা যখন সুবেদার আমিনুল আউয়ালের বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে , তখন তিনি একমনে ঈশ্বরকে ডাকছেন , যেন তিনি সজলকে এই দৃশ্য দেখতে না দেন । ঈশ্বর তার প্রার্থনা শুনলেন । ঠিক যে মুহূর্তে রাইফেল থেকে গুলি বের হল , ঠিক তখনি জ্ঞান হারালো সজল । তার মায়ের রক্তাক্ত নিথর দেহটা তাকে দেখতে হল না , তাকে দেখতে হল না তার দিদির শরীর নিয়ে কয়েকটা নরপশুর আদিম উল্লাসে মেতে ওঠা......
এই প্রথমবারের মতো রাইফেলের ট্রিগার প্রেস করার সময় সুবেদার আমিনুল আউয়ালের বুকটা একটু হলেও কেঁপে উঠলো ।
সজলকে যখন ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয় , তখন সে সম্পূর্ণ অজ্ঞান । তার নিথর দেহটাকে এক কোণে ফেলে রাখা হয় । কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে সজল নিজেকে একদল মিলিটারি আর রাজাকারদের সামনে আবিস্কার করে । সে তার ঠোঁটের কোণে রক্তের নোনতা স্বাদ অনুভব করে ।
“মাই বয় ।তুমহারে সাথ অউর কউন কউন থা ?তুমলোগোকা ক্যাম্প কাঁহা পার হ্যা? আগার বাতা দোগে তো জাদা তাকলিফ নাহি পউছাউঙ্গা ।”---সজলকে বারবার একই কথা বলতে থাকে মেজর ইউসুফ বিন নাভেদ ।কিন্তু সজল নিরুত্তাপ । হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে মেজর ।বাম হাতের কনিষ্ঠ আঙুলটি কেটে নেওয়ার নির্দেশ দেয় । আঙুলটি কেটে নেওয়ার সময় সজল তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করে কেঁদে উঠে । ধীরে ধীরে অবচেতনার জগতে হারায় সে ।
সকালবেলা রাজাকারদের লাথিতে যখন চেতনা ফিরে সজলের , তখন তার সারা শরীর জুড়ে তীব্র যন্ত্রণা ; মন জুরে অপমান , ক্ষোভ আর ঘৃণা মেশানো ভোঁতা কিন্তু তীব্র একটা অনুভুতি ।রাজাকারগুলো তাকে টানতে টানতে গাঙের পাড়ে এসে দাঁড় করায় । তারপর বন্দুকের বাঁট দিয়ে মেরে মাটিতে ফেলে দেয় ।
মাটিতে শুয়ে সজল ভাবতে থাকে সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া তার ক্ষুদ্র অথচ ঘটনাবহুল জীবনের কথা । ভাবতে ভাবতে সে তার শৈশবে ফিরে যায়......
সে যখন অনেক ছোট , তখন তার বন্ধুদের মাঝে একবার প্রজাপতি ধরার হিড়িক পড়ে। তাদের গাঁয়ের পাশে যে পাহাড়টা আছে তার নীচের সমতলে কেন জানি সেখানটায় অনেক প্রজাপতি ঝাঁক বেঁধে উড়ে বেড়াতো । তার স্কুলের অন্য বন্ধুরা ইতিমধ্যেই বেশ কিছু প্রজাপতি ধরেছে , শুধু তার হাত শুন্য ।তাই সে পণ করেছে তাকে এবার প্রজাপতি ধরতেই হবে ।
একদিন সে গেল পাহাড়ের পাদদেশে । গিয়েই দেখল সেখানে উড়ছে প্রজাপতির দল । সবই ঠিক আছে , কিন্তু যখন সে প্রজাপতির দলটার দিকে হাত বাড়ায় ঠিক তখনই তার পা কেটে গেল কাঁটাঝোপে । এরপর কাটল ডান হাত । এরপর বুকের কাছে ছিঁড়ে গেল ।কিন্তু একগুঁয়ে জেদি সজলের তাতে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই । তার লক্ষ্য একটাই – প্রজাপতি ধরা । সে আবার হাত বাড়াল । তার আঙুল আলতো পরশ পেল প্রজাপতির ডানার ............
“উঠ শালা মালাউন । তরে তোর মার কাছে পাঠানোর টাইম আইসে” ---আজিম মোল্লার লাথিতে ভাবনায় ছেদ পড়ল সজলের । তাকে উঠিয়ে দাঁড় করান হল । তার সামনে রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে আছে ২টা পাকিস্তানি হানাদার । তার মেরুদণ্ড দিয়ে কেমন যেন একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল । হঠাৎ সে দেখতে পেল দিগন্ত পেরিয়ে একটা বিশাল প্রজাপতি তার লাল-সবুজ ডানা ছড়িয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে । ডানার প্রতিটা দোলায় চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে মুগ্ধতা মেশানো বিস্ময় । নব-আনন্দে জাগছে চারপাশ......
সজল শান্ত চোখে তার চারপাশে দাঁড়ানো মানুষ নামের কুকুরগুলার দিকে তাকায় । তার চাহনিতে ছিল প্রাপ্তির আনন্দ , মুগ্ধতা জড়ানো ভাললাগা আর আশেপাশের পথ-কুকুরদের জন্য অনেক অনেক ঘেন্না । কিন্তু সেখানে ভয়ের ছিটেফোঁটাও ছিল না......
.........পরক্ষণেই বেশ কয়েকটি বুলেটের গর্জনে কেঁপে উঠলো সূর্যের আলো.........
পুনশ্চঃ সজল তার ছেলেবেলায় প্রজাপতিটা ধরতে পেরেছিল কিনা – তা আমাদের জানা নেই । কিন্তু সজলদের কারণে লাল-সবুজ ডানার প্রজাপতিটার পরশ আজ আমাদের সবার শরীরে ।
২৩ অক্টোবর - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৫ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪